সময় . . . পরিবেশ . . . পরিস্থিতি; একই সূত্রে বাঁধা
এই তিনটি শব্দই যথেষ্ট, ‘সম্পর্ক’ নামক বিশেষ্য পদটির জন্য। পাঠ্যপুস্তকে এই
শব্দগুলি শুধুই অক্ষরসমষ্টি হলেও, জীবনের খাতায় এরা অনেকটাই দামি, ক্ষমতাশালী। যেমন,
একদিকে, একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে বুনে দেয় সম্পর্কের মায়াজাল; ঠিক তেমনই, বিপরীতপ্রান্তে
একটু একটু করে ছিঁড়তে থাকে সেই বন্ধনেরই জালবিন্যাস। নিজেদের অজান্তেই সেই বাঁধন
কখন আলগা হয়ে যায়, আমরা জানতেও পারি না।
কথায় বলে, “Time has all answers”; শুধু প্রয়োজন একটু
অপেক্ষার . . . নাকি! উপলব্ধি’র! সময়ের ব্যস্তময়তা, পরিবেশের কাঠিন্যতা আর পরিস্থিতির
বাস্তবিকতা অনায়াসেই ফিকে করে তোলে সম্পর্কের গভীরতাকে। কিন্তু উপলব্ধি! সময়ের
অভাবে হারিয়ে যাওয়া এই সামান্য অনুভুতিটাই একমাত্র পারে, সেই আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্কের
সুতোকে পুনরায় শক্ত করতে। ঠিক যেমন, আজ আমার উপলব্ধি, একটু একটু করে আমার জীবনে ফিকে
হতে থাকা সম্পর্ককে বেঁধে দিয়ে গেল এক অটুট বন্ধনে। হ্যাঁ, সম্পর্ক . . . আমার
সাথে, আমার বাবা’র।
আজকের একবিংশ শতাব্দীতে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে, সবরকম বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে পাশে
সরিয়ে রেখে খুব ইচ্ছা করল চিঠি লিখতে, বাবাকে। What’s App, Messenger, Skype’এর যুগে চিঠি শব্দটা বড্ড বেমানান লাগছে, তাই না! জানি,
কিন্তু বাবার প্রতি আমার এই দীর্ঘবছরের negligency’র কাছে আজ আমি বড্ড লজ্জিত;
লজ্জিত তোমাকে দেওয়া আমার সকল শব্দহীন অপমানের জন্য। তাই, চিঠিকেই বেছে নিলাম তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার
মাধ্যমস্বরূপ।
~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*
শ্রীচরণেষু বাবা,
অবাক হলে, DAD না লিখে ‘বাবা’ লিখলাম বলে! ভাবছো, বাংলাভাষাকে ভুলতে বসা তোমার মেয়ের আজ
হঠাৎ হল টা কি! ফোন, ভিডিও কল ছেড়ে একেই চিঠি, তারউপর আবার সেটা বাংলা ভাষায় লেখা। আসলে, আজ তোমাকে অনেককিছু বলতে ইচ্ছা করছে, যেগুলো ঐ
ফোনে বা ভিডিও কলে আমি হয়ত বলে উঠতে পারব না। তুমি তো জানোই, তোমার মেয়ে শ্রীতমা
বরাবরই বাংলায় বড় কাঁচা; তাই ঐ ভাঙাচোরা বাংলাতেই লেখার চেষ্টা করলাম। তুমিই তো আমাকে
ছোটবেলায় বলতে, “চেষ্টা করলে, সাফল্য পাবই”।
জানো বাবা, এখানে আশেপাশে এতো multi storied buildings’এর মাঝে বড্ড দমবন্ধ হয়ে আসছে, আমার। তোমার মনে আছে,
আমরা যখন কলকাতায় আমাদের ঐ ফ্লাটটা কিনলাম; তুমি একটুও খুশি ছিলে না। বারবার বলতে,
এইখানে অক্সিজেনের বড় অভাব . . . চারপাশটা শুধুই ভরে রয়েছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বিষাক্ত
হাওয়ায়; তাই নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার।
তোমার মুখে কতবার শুনেছি, দক্ষিণদিকে সোনাঝুরি জঙ্গল আর এক মুক্ত পরিমণ্ডলের মাঝে তোমার
বীরভূমের সেই একতলা বাড়িটার কথা। সন্ধ্যেবেলায় গাছের পাতাগুলো হাওয়ার দোলায় মেতে
উঠে ফিসফিসিয়ে কত কি না বলত! আমার আজও মনে আছে, প্রতিবার আমার স্কুলের Annual Exam’এর পর, তুমি অনেক আশা নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে, তুই যাবি বীরভূমে আমার সাথে,
আমার বাড়িতে? সেখান থেকে আমরা শান্তিনিকেতন যাব। তোরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের poems পড়িস তো! তোকে আমি তাঁর আশ্রমে নিয়ে যাব; যাবি আমার সাথে? আর আমি সঙ্গে সঙ্গে
মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাতাম। তোমার চোখেমুখে সামান্যটুকু আনন্দের দেখা মিলতেই, তা ঢাকা
পরে যেত মায়ের কঠিন শব্দের চাপে। তোমার নেওয়া নির্নয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কড়া আপত্তি
জানিয়ে মা ঘোষণা করে বলতো, “না, এবারে summer
vacation’এ শ্রীতমা আমাদের সাথে হয় সিঙ্গাপুর যাবে কিংবা মানালি। তোমার তো দৌড় খালি ঐ
দার্জিলিং অবধিই। যা রোজগার কর, তাঁর অর্ধেকটাই তো তুলে দিয়ে আসো, তোমার সেই
বীরভূমের দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের দানছত্রে। আমাদের আনন্দের, সখের কথা আর কবে ভাবলে! .
. . আমার মেয়েটাকে একটু বড় বড় স্বপ্ন দেখাতে পারো না, সুযোগ পেলেই খালি টেনে যাবে
সেই ধ্যারধ্যারে গ্রাম, বীরভূমে।” একরাশ ক্ষোভ ফেটে পড়ত মায়ের গলা দিয়ে; আর সাথে ছোট-বড়
নানারকমের অভিযোগের তীর ছুটে আসত তোমার দিকে। কখনো চুপ করে থাকতে, কখনো হয়ত বা চোখ
নীচু করে মা’কে বলতে, “শ্রীতমা কি তবে কখনোই চিনতে শিখবে না তাঁর বাবার ভিটেমাটির
পরিচয়”?
সময়ের সাথে সাথে পেড়িয়ে গেল আমার বয়সও; আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম ‘স্ট্যাটাস’
শব্দের বাস্তবিকতাকে। বুঝলাম, টাকা নয়, বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ডলার কিংবা পাউন্ড কামানোই হল actual status; যার জন্য প্রয়োজন অনেক অনেক পড়াশোনা, heavy
weighted degrees’। মায়ের কাছে প্রায়ই শুনতাম,
তোমার মত দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা মানে বোকামি। তখন থেকেই জানলাম, ইন্ডিয়াতে মানুষ থাকে না, এদেশ তো বোকাদের বাসভূমি। মাঝে মাঝে জানো বাবা, আমারও ইচ্ছে করতো তোমার জন্মভূমি বীরভূমে যেতে, নিজের চোখে দেখতে তোমার
সেই বাড়ি, সোনাঝুরি জঙ্গল, অনুভব করতে সন্ধ্যেবেলার মৃদু হাওয়ার সেই মিষ্টত্যকে। কিন্তু প্রতিযোগিতা, comparison আর status’এর ধারালো অস্ত্রের কোপে একটু একটু করে খসে পড়লো আমার সেইসব ইচ্ছেডানাগুলো।
আমার এখনো মনে আছে, ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এসে মাঝে মাঝে তুমি আমার পাশে এসে চুপটি করে বসে, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে, “শ্রীতমা . . . ‘বাংলা’ তোদের থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ তাই না? একটু আধটু পড়িস তো?” আমি ঘাড় নেড়ে বলতাম, “না ড্যাড . . . মাম্মি বলেছে ওটা অতো ভালো করে না পরলেও চলবে”। তুমি হতাশ হয়ে বলতে, “মাতৃভাষাকে ভুলে যাবি”! তোমার এই হতাশার প্রত্তুত্যরে আমার কিছু বলার আগেই মাম্মি রনংদেহি মনভাব নিতে বলে উঠত, “হ্যাঁ যাবে ভুলে। তুমি তো কলেজের বাংলার প্রফেসর, ক’জন জানে তোমার নাম? জীবনে তো ঐ শুধু নন্দনে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করে উঠতে পারলে না। আমার মেয়ে বিদেশে যাবে, আর সেখানে English language চলে, ওসব ‘বাংলা’র কোন জায়গা নেই সেখানে”।
২৫শে বৈশাখের সেই সন্ধ্যেটা খুব মনে পড়ে আমার আজও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে তুমি আমায় একটা কবিতা শিখিয়েছিলে আর বলেছিলে, “অক্ষরগুলো তো চিনিস, তাই না হয় দেখে দেখেই বলবি ওনার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে”। কিন্তু মা বড় বড় চোখ করে declare করলো, ওসব খুচরো সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব না দিয়ে আমি যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বসি। আবারও সেই স্ট্যাটাসের কবরে চাপা পড়ে গেল তোমার ‘ভালোলাগা’।
ধীরে ধীরে আরও বড় হলাম; ওয়েস্টার্ন ডান্সের পাশাপাশি স্প্যানিশ গিটারও শিখতাম আর তুমি মাঝে মধ্যেই আমাকে বলতে, রবীন্দ্রসংগীত শুনবি? গিটারে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর তোল না, মা!
আধুনিকতার জাঁকজমকতা একটু একটু করে নিজের অজান্তেই আমাকে কখন যে তোমার কাছ থেকে
এতটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে, খেয়ালই করি নি। ততদিনে স্ট্যাটাস শব্দটা আমাকে শিখিয়ে
দিয়েছে, বাবা নামক মানুষটা আসলে বড্ড poor; তাকে Dad বলে ডাকলেও মানুষটা আসলে গুড ফর নাথিং। তাই মায়ের মতো আমিও একদিন বলেছিলাম, “ড্যাড, আমাকে অনেক বড় হতে হবে; ইউনিভার্সিটিতে বাংলার প্রফেসর হলে, আমার চলবে না। তুমি সেদিনও মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলে আমার ঘর থেকে। একটু একটু করে আমার আর মায়ের জগতে তুমি রয়ে গেলে নিতান্তই ব্রাত্য হয়ে। একই বাড়িতে থাকলেও তুমি ছিলে সম্পূর্ণ অন্য গ্রহের বাসিন্দা। কতবার মা তোমাকে ঠেস মেরে বলেছে, “তোর বাবার জন্য আমার কোনো সাধই পূরণ হয়নি; না পেরেছি আমেরিকা যেতে, আর না পেরেছি আলিসান বাংলোয় থাকতে। জীবনভোর নিজের উপার্জনের টাকায় শুধু চ্যারিটিই করে গেল মানুষটা”।
জানো বাবা, এইভাবেই আস্তে আস্তে না তোমার
সংজ্ঞাটা পাল্টে গেল আমার কাছে, চুপচাপ বই মুখে নিয়ে কিংবা দিনরাত পেন নিয়ে সাদা কাগজে আঁকিবুকি কাটা একজন unsocial, affable মানুষ; নিজস্বসৃষ্ট খোলসের মধ্যে বাস করা একটা নির্লিপ্ত প্রাণী। মা অনেকবার বলতো আমাকে, তোর বাবা একজন লুজার, হেরে যাওয়া একটা মানুষ। যদিও কেন জানি না, তোমার চোখে কখনো হারের কোন গ্লানি দেখিনি, আমি।
বছর বছর ভালো রেজাল্ট করতে করতে মনের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণাই তৈরি হয়ে
গিয়েছিলো আমার যে, সত্যিই! শিক্ষিতরা কখনোই ইন্ডিয়ার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে না। মা সবসময় ছোট মেসোমশাইয়ের সাথে তোমাকে compare করে বলতো, “মেসোকে দেখে শেখ . . . তিনবার লন্ডন ঘুরে এলো; বছরের বেশিরভাগ সময়েই দেশের বাইরে থাকে; আর তোর বাবাকে দেখ, বেড়াতে যাওয়া মানে খালি হরিদ্বার আর নয়ত
বেশি দূর হলে একঘেয়ে সিমলা”।
ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, আত্মীয়-স্বজন সকলেই ছোটমেসোকে আলাদা একটা সম্মান করতো। মামার বাড়ি গেলে দাদুও আমাকে বলতো, “ভালো করে পড়াশোনা কর শ্রীতমা, ছোটমেসোর মত হয়ে দেখা তো দেখি”! কিন্তু, কেউ কখনো বলতো না বাবার মত হয়ে দেখা তো! ছোটমেসোর মত আমিও সবসময় ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করতাম। ভুল করেও বাংলাটা বলতাম না। ধীরে ধীরে ছোটমেসোই হয়ে উঠল আমার আইডল। মাসিমনির বাড়িতে গেলেই আমি গল্প জুড়ে দিতাম মেসোর সাথে; তাঁর গল্পকথার ভেলায় ভেসে স্বপ্নের দেশের ছবি আঁকতাম আমি নিজের মনেই। না বাবা, সেখানে তোমার জন্মভূমির মত লালমাটি ছিল না। মেসোর অ্যালবামে বিদেশের ছবি দেখতে দেখতে মনে হতো . . . মা ঠিক বলছে, ওটাই জীবন।
আমি তখন সদ্য বি.টেক’এ ভর্তি হয়েছি। তুমি একদিন বলেছিলে, “শ্রীতমা . . . পারলে আমাকে বাবা বলে ডাকিস না রে; ‘ড্যাড’ শব্দটা শুনলেই কেমন যেন হাঁসফাঁস করে ওঠে আমার ভেতরটা। আমি বেশ বিরক্ত হয়েই বলেছিলাম, তোমাকে না ডাকলেই বা তোমার কি আসে যায়! তোমার চোখে সেদিনও অসহায়তার চিহ্ন দেখেছিলাম; কিন্তু সেটা
উপলব্ধি করতে পারিনি তখন আমি। কারণ, ডাল-ভাত খাওয়া ভেতো বাঙালিরা যে তখন আমার দু’চোখের বিষ। ছাত্র পড়ানো ছাড়া জীবনে যে আর কিছুই করতে পারেনি, তাকে শ্রদ্ধা করার ইচ্ছাশক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। কলেজে প্রথমদিকে সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করতো, হ্যাঁ রে শ্রীতমা, তোর বাবা প্রফেসর? আমি বিদ্রূপ করে বলতাম, হ্যাঁ বাংলার। মাম্মি বলতো, “শ্রীতমা, বন্ধুরা বাবা কি করেন জিজ্ঞাসা করলে শুধু বলো যে বাবা প্রফেসর, কোন সাবজেক্টের সেটা বলার দরকার নেই; শুনলে হাসবে”। একটা মানুষ একফোঁটা ইংরেজী না জেনেই জীবন কাটাচ্ছে জানলে তারা হার্টফেল করবে”। তুমি মুচকি হেসে বলতে, “সুচেতনা নিজের মাতৃভাষাকে অসম্মান করো না”। প্রত্যুত্তরে মা ব্যঙ্গ করে বলতো, “জানো অয়ন, মাঝে মাঝে তোমাকে দেখে করুণা হয়; হাসি পায় তোমার দেশভক্তি দেখে। আসলে কি বলতো, যারা জীবনে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়, তারাই দেশের মাটি আগলে পড়ে থাকে আর নিজের ল্যাঙ্গুয়েজের প্রতি ভালোবাসা দেখায়। এটাও একটা মুখোশ, বুঝলে, নিজের অক্ষমতা ঢাকার মুখোশ। দেশভক্তির মুখোশ পরে তুমি নিজের অক্ষমতা ঢাকছো নিজের সন্তানের কাছেও। হেরে যাওয়া মানুষেরা না এভাবেই নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দেয়। রঞ্জনকে দেখে শেখ কিছু; কীভাবে দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে নিজের যোগ্যতা
প্রমাণ করছে, কত সম্মান অর্জন করছে, নামি কোম্পানিতে চাকরি করছে, এক গাদা করে মাসে স্যালারি পাচ্ছে; বউ, মেয়েকে কতটা সুখে
রেখেছে। আর এদিকে তুমি ... Totally worthless”!
মামাবাড়িতে গেলে
দেখতাম, তোমাকে সবাই জিজ্ঞেস করতো, “অয়ন, সারাটা জীবন ইউনিভার্সিটি আর বাড়ি করেই কাটিয়ে দিলে?” তুমি
নম্র গলায় বলতে, “কত ছাত্র তৈরি করে ভবিষ্যতের মুখ গড়লাম; ওরাই আমাদের দেশকে উজ্জ্বল করবে”। দাদু ব্যঙ্গ করে বলতো, “আমারই ভুল, শুধুমাত্র প্রফেসরের পেশাটা দেখেই সুচেতনার বিয়েটা দিলাম। আমার বোঝা উচিত ছিল, যাই করুক না কেন, ultimately originটাতো সেই বীরভূমেরই। সুচেতনা যতই চেষ্টা করুক না কেন, শরীর থেকে মাটির গন্ধটা ধুয়ে ফেলতে পারেনি এখনো”। দাদুর এই অপমানের উত্তরে নিরুদ্বেগ হয়ে তুমি
হেসে বলতে, “পুরো গন্ধ না ওঠাই ভালো বাবা, আবার তো সেই মাটিতে গিয়েই মিশতে হবে”।
IT join করার পরেই আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল বিদেশে পাড়ি দেওয়া। মা সবসময়ই বলতো, জীবনে তো তোর বাবাকে নিয়ে গর্ব করতে পারিনি, এবার তোকে নিয়েই করবো। যোগ্যতার নিরিখে বেশিদিন সময় লাগেনি আমার UK পাড়ি দিতে। আজ প্রায় বছর খানেক হলো আমি বিদেশের মাটিতে। এই দীর্ঘ একটা বছরে জানো বাবা, অদ্ভুত একটা জিনিস খেয়াল করলাম খুব কাছ থেকে; এদেশের বেশকিছু মানুষ ইন্ডিয়ানদের দিকে একটু হলেও করুনার চোখে তাকায়। ভাবখানা এমন করে যেন, ওরা আমাদের দয়া করছে বলেই, আমরা এখানে রোজগার করতে পারছি। বড্ড অপমানিত বোধ করি মাঝে মাঝে। এইখানে এসে বুঝতে পেরেছি, মায়ের কথাই ঠিক, বাংলা ভাষাটা সত্যিই আমার কোনো কাজে লাগে নি; কারণ সারাক্ষণই তো
শুধু গরগরিয়ে ইংরেজি ভাষাতেই চলে কথপকথনপর্ব!
এদেশে এসে চাকরি করছি, আবার মাসের শেষে আকর্ষণীয়
salary’ও পাচ্ছি; কিন্তু পাচ্ছি না তেমনভাবে সন্মান . . . তোমাকে তো তাও তোমার দু’শো জন ছাত্র হলেও সম্মান করে, কিন্তু এখানে তো . . .। জানো বাবা, এখানে আমার বেশ কিছু বন্ধু আছে, যারা অবশ্য আমি ইন্ডিয়ান বলে আমাকে আলাদা সম্মান করে; কারণ এদের কাছে
আমাদের ভারতীয়দের পরিচয় হল, আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বোস, বিবেকানন্দের দেশের মানুষ।
কিছুদিন আগেই আমাদের অফিসে দুদিনের ছুটি ছিল। সেদিন আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে গিয়েছিলাম অক্সফোর্ড ঘুরতে। ওখানে এক বাঙালী প্রফেসরের সাথে আমাদের পরিচয় হয়, নাম অভিক চক্রবর্তী। জানো বাবা, সে আমাদেরই কলকাতার, যাদবপুরের ছেলে। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিটা আমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে অভিক হঠাৎ বলে উঠলো . . . “আমাদের ইউনিভার্সিটিতে বাঙালি রাইটারের লেখা বই পড়ানো হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের উজ্জীবিত করার জন্য mainly গত বছর থেকে এই বইটা আমদের ইউনিভার্সিটির syllabus’এ ঢোকানো হয়েছে”। জানো বাবা, বহুদিন পরে বাঙালি শব্দটা শুনে, বলতে পারো একপ্রকার একাত্ম হয়েই আমার জানতে ইচ্ছা
করল সেই বইয়ের লেখকের নাম। তাই কৌতুহলবশত তাকালাম অভিকের হাতে ধরে থাকা সেই বইটার দিকে। বইটার cover
page’এ লেখা ছিল, “The winner-Written by Dr. Ayan mukharjee”। লেখকের নামের সাথে তোমার নামের মিল দেখে বইটা হাতে নিলাম। পাতা ওল্টাতেই দেখলাম, সাদা আর আকাশি রঙের পাঞ্জাবী পরা তোমার সেই ছবিটা আর মুখে সেই বোকা বোকা হাসি; মায়ের ভাষায় যেটা চূড়ান্ত আনস্মার্ট।
চারশো পাতার এই বইটাতে রয়েছে, তোমার চোখে উইনার শব্দের অর্থ। সাবলীলভাবে
বুঝিয়েছ এইখানে, হারতে হারতেও কীভাবে বিজয়ী হওয়া যায়। জীবনে কারা জেতে আর কারা হেরে গিয়েও জিতে গেছি ভেবে উল্লাস করে। তোমার বইটা পড়তে পড়তে নিজেকে সেইদিন খুব বড় লুজার বলে মনে হয়েছিল। সারাজীবন কনভেন্টে পড়েও ইংরাজিতে আমি তোমার মত এতো সুন্দর বাক্যগঠন করতে পারবো না বাবা। কাজ চালানো ইংরেজী আর অনুভূতি দিয়ে গড়া একটা বাক্যের মধ্যে কতটাই না পার্থক্য! তবে আমরা যে জানতাম, তুমি বাংলা ছাড়া আর কিছুই জানো না? . . . তুমি অবশ্য মাঝে মাঝেই বলতে, জানিস শ্রীতমা, এটা অনেকেই জানেন না, গীতাঞ্জলির অনেক ইংরেজীই কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি; যদিও পরে সেইসব অনুবাদ করা হয়। আচ্ছা বাবা, তুমি কেন দাদুকে, রঞ্জন মেসোকে, মা’কে কখনো কিছু বলোনি? কেন সারাটা জীবন সবকিছু জেনেও না জানার অভিনয় করে গেলে? পার্সোনালিটি ডেভলপমেন্টের ওপরে এমন একটা বই যে তুমি লিখতে পারো, আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। অথচ মা সারাজীবন বলে গেল, “তোর বাবার কোনো পার্সোনালিটি নেই”।
তোমার আক্ষেপ ছিল, তোমার মেয়ে বোধহয় বাংলাভাষাকে ভুলেই গেছে বরাবরের জন্য; কিন্তু দেখো, আমি কিন্তু বাংলাটাকে ভুলিনি; বাংলায় চিঠি লিখে আর তোমাকে বাবা ডেকে আমিও কিন্তু উইনার হলাম বাবা। হ্যাঁ, হয়তো তোমার মত গুছিয়ে লিখতে পারলাম না। তুমিই তো বলেছো, যে জয় করতে পারে তার ভিতরের আনন্দটা কাউকে দেখানোর প্রয়োজন হয় না, একমাত্র সেই উপলব্ধি করতে পারে। জানো বাবা, সেইদিন খুব গর্বের সাথে আমি অভিক চক্রবর্তীকে বলেছিলাম, এই অয়ন মুখার্জীই হলেন আমার বাবা; The biggest winner I have ever seen in my life।
খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি বাবা, তোমার কাছে; আর
এবার থেকে বাবা বলেই ডাকবো তোমায়। নিজের অজান্তেই তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি, জানি। পারলে
আমাকে ক্ষমা করে দিও। তবে, এবারে ফিরেই আমরা দু’জনে মিলে কিন্তু যাব তোমার সেই লাল
মাটির দেশে, বীরভূমে; . . . নিয়ে যাবে তো বাবা, আমাকে?
ইতি,
তোমার শ্রীতমা