এ কোন প্রভাতসংগীতে ঘুম ভাঙল আমার! . . . কি সুমিষ্ট সুর! কোথা থেকে সে ভেসে আসছে আমার কানে! তাড়াতাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে দেখি, এ যে কোন একক সুর নয়, সুমিষ্ট স্বরের ঐকতানে আজ মেতে উঠেছে এই ধরিত্রী; আর তারই মাঝে আমি আত্মভোলা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি নিশ্চুপ হয়ে। পাখিদের কাকলিতে ভরে উঠেছে পরিমণ্ডল। কোথাও কোকিলের ‘পিউ কাহা’র ছন্দ, শালিকের ‘চিড়িক’ শব্দ; আবার কোথাও চড়ুই পাখির ‘কিচির-মিচির’ ডাক . . . নানা সুর, নানা তালের মেলবন্ধনে মুখরিত আজ চারিধার।
“ ওরে পাখি,
থেকে থেকে ভুলিস কেন সুর,
যাস নে কেন ডাকি-
বাণীহারা প্রভাত হয় যে বৃথা
জানিস নে তুই কি তা”।
প্রকৃতির এইরূপ শোভার একফোঁটা রস পান করতে ছাদে উঠে, অপার বিস্ময়ে
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম উর্দ্ধ গগণে।
দেখি, আজ সমস্ত আকাশ যেন মুখ ঢেকেছে নীলাম্বরী চাদরে! . . . আর তারই মাঝে মাঝে কোন সূচিশিল্পী সেই নীল চাদরের গায়ে পরম যত্নে সাদা-সাদা পেঁজা
তুলোর মতো মেঘের ফুল বুনে চলেছে, অবিরত। উন্মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে, যখন একদিকে,
এই অপুর্ব নীলাভ শোভায়ে ভিজে গেল আমার মন-প্রাণ; তখন পূর্ব দিগন্ত ছেয়ে গেল রবির ছটায়। রক্তিমের টুকরো টুকরো রশ্মিকণা এসে
মিশছে সেই নীলাম্বরী আকাশের কোলে, আর তা একটু একটু করে লাল আবীরের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সেই
সাদা মেঘের আনাচে-কানাচে। . .
. আহা! নীলাম্বরের সারা গায়ে নানা রঙের আঁকিবুঁকি . . . যেন এক জীবন্ত
ক্যানভাস!
“ নীলাম্বরী আকাশ আমি-
মেঘের ভেলায় ভাসি।
রৌদ্র-ছায়ার খেলায় আমি,
কাটি আঁকিবুঁকি”।
চারপাশে সবাই যখন মেতে
উঠেছে নিজ নিজ সুর-তাল-ছন্দে; ঠিক তখনই শুনতে পেলাম আমি, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা মোরগের ডাকখানি। আচমকা, কানের কাছে খুটখুট শব্দে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি, ছাদের কার্নিশ ঘেসে দণ্ডায়মান গাছটিতে কাঠঠোকরা পাখি বেড়িয়ে পড়েছে তখন তার খাদ্য অন্বেষণের রোজনামচায়। . . . “রোজনামচা”!!. . . আচ্ছা! তাহলে এতদিন তো শুনতে পাইনি এইসব রোজনামচার কলতান! আমার কানে এসে জানান
দেয়নি তাদের উপস্থিতি! না . . . আমিই তাদের আসতে দিইনি আমার কাছে!
এ কোন সকাল দেখছি, আমি আজ! শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতির বুকে আজ কেবলই পাখিদের কলরব; গাছে-গাছে কোন অদৃশ্য শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় বর্নময় প্রজাপতির আনাগোনায় এক পরিপূর্ন রবিপ্রভাত। সত্যিই! ইশ্বরের এই অপরূপ সৃষ্টিকে এতো সূক্ষ্মভাবে আগে কখনো আমি খেয়াল করিনি তো! নিজেই প্রশ্ন করি নিজেকে,
আবার উত্তরও আসে নিজের মন থেকেই!!
সত্যিই তো! এইসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তার অবকাশ, এতদিন কি ছিল! কিন্তু আজ, হঠাৎ করেই যেন কেউ আমার জীবনের সকল ব্যস্ততাকে চুরি করে, তার বদলে আমাকে দিয়ে গেল অসীম অলস দিনযাপনের ছুটি। আচমকা, আমার কানে ফিসফিসানি শব্দে কে যেন বলে উঠলো, . . . “খুব তো সবাই ছুটি ছুটি করে হা হুতাশ করতিস এতদিন! সামান্যটুকু উপলক্ষ্য পেলেই আহ্লাদিত হয়ে বেরিয়ে পড়তিস দূর-দূরান্তের পথে; নতুন কিছু দেখার লোভে। কিন্তু, এতটুকু সময় দিয়ে, নিজের বাড়ির চারপাশটা একবারও কি কখনো একটু ভাল করে তাকিয়ে দেখেছিস? ওরে বোকা, সেখানেই যে লুকিয়ে রয়েছে কত অজানা-অদেখা সম্পদের ভাণ্ডার! সেইসব অবশ্য তোরা দেখার চেষ্টাই করিস নি কখনো! যে মূল্যবান সৃষ্টিকে তোরা এতদিনেও খুঁজে পাসনি, কতগুলো বছর আগে তোদের রবিঠাকুরই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে গিয়েছিলেন . . .
“বহুদিন ধরে' বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু”।।
তোরা, এই বিশ্বমানবজাতি, সত্যিই বড্ড স্বার্থপর। প্রকৃতির কাছ থেকে বরাবরই শুধু স্বার্থপরের মত তোরা উপভোগ করে গেলি কতকিছু; কই! কখনো মন ভরে আমাকে দিলি না তো কিছু! আমার সব ভালোলাগাকে আপন করে নিলি নিজের মত করে আর পরিবর্তে
তোদের কাছ থেকে শুধুই পেলাম আমি, তোদের হীনমন্যতার পরিচয়। তোদের ঐ ‘ধর্ষিত’ শব্দের বিষে আজ আমিও কলুষিত। চমকে উঠলি? মনে কর তো, দীর্ঘ
বছর ধরে কীভাবে নির্যাতন করে চলেছিস আমার উপর তোরা! দিনের পর দিন আমার গায়ের উপরেই ফেলেছিস কত বোতল, প্লাস্টিক, কাগজ, থুতু-কফ-পানের পিক, . . . না জানি আরও
কত কিছু। এমন কি নির্লজ্জ-বর্বর-নোংরা মনের বেশকিছু পুরুষ আমার শরীরে তাদের নোংরা জল ছিটোতেও এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি কখনো।
সত্যিই তো! এতকিছু দিয়েছিস তোরা আমাকে . . . না, না; এরপরেও তোদের স্বার্থপর বলতে
পারব না। রোজনামচার দমবন্ধকর জীবন থেকে তোরা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে বারংবার আমার
কাছেই ছুটে আসিস, কিন্তু তার পরিবর্তে তোদের দেওয়া এই কালো-কালো বিষাক্ত ধোঁয়ায় আমার শ্বাস নিতে না বড্ড কষ্ট হয়, জানিস। আমারও দমবন্ধ হয়ে আসে, যখন তোরা আমার এই কষ্টের কথা এতোটুকু না ভেবে, আমার বুক থেকে শতসহস্র গাছ নির্মমভাবে কেটে ফেলছিস প্রতিদিন।
আমি কিন্তু এতকিছুর পরেও সেই পরন্ত শিশিরে সিক্ত হয়ে থাকি, তোদেরই জন্য। কিন্তু, আমার সেই অপেক্ষার দাম তোরা আমাকে কখনোই দিস নি। ওরে! আজও আমি তোদের বুক দিয়েই আগলে রেখেছি, রাখার চেষ্টাও করেছি
এতকাল; কিন্তু বারবার তোরা আঘাত করেছিস আমাকে, রক্তাক্ত করেছিস আমার শরীরকে, ছিন্নভিন্ন
করেছিস আমার অন্তর আত্মাকে। নিজের উপর হতে থাকা, দীর্ঘদিনের এই অত্যাচার’কে আর
সহ্য করতে না পেরে আজ আমি বিদ্রোহী, আমি সরব, আমি উত্তাল! ভাল করে ভেবে দেখ তো, আজ
আমার এই রুদ্রদাহ রূপের জন্য কি কোথাও তোরা নিজেরাই দায়ী নোস? তোরা আজ কষ্ট পাচ্ছিস, আতঙ্কিত হচ্ছিস, স্বজন-হারা হচ্ছিস; . . . সবটাই কিন্তু নিজেদের কু-কর্মের ফলেই। তোদের কর্মফলেই আজ তোরা গৃহবন্দী, আবার অনেকেই গৃহহারা।
আচমকা আমার সম্বিৎ ফিরে এল, মনে হল, কেউ যেন এতক্ষণ কোন এক নির্মম সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল! ঠিকই তো! উষার নীলাভ রক্তিম আকাশকে আমরা কি কখনো বাড়ির জানালা বা ছাদ থেকে দেখার চেষ্টা করি? নাহ! আমাদের অপরাধ সত্যিই অপরিসীম। ভোরে মোরগের এই ডাক, পাখিদের কলরব, লালচে-নীল আকাশ আর তার গায়ে সেজে
ওঠা মেঘের ফুল; এই সবকিছুই যেন এতদিন যন্ত্রের আধুনিকতায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল; হারিয়ে গিয়েছিল আমাদের জীবন থেকে . . .
নাকি, আমরাই তাদের অনেকটা দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলাম নিজেদের কাছ থেকে!
ধিক! মানবসমাজ . . . ধিক! নিজেদের উন্নাসিকতা-লোভ-শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারই আজ আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছে। আজ আমরা বন্দী আমাদের কু-কর্মের খাঁচায়, আর এতদিন আমাদের
হাতে কারারুদ্ধ প্রকৃতি, আজ উন্মুক্ত। . . . নাহ! অনেক শিক্ষাই তো পেলাম, তাই করজোরে, মাথা নিচু করে, ধরিত্রীর কাছে শুধুমাত্র এইটুকুই বলতে চাই . . . “ক্ষমা কর মোদের, যত অপরাধ করেছি তা মোরা মাথা পেতে স্বীকার করে নিলাম। ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই ব্যস্ত সময়কে। যত অপরাধ মোদের, সবকিছুকে ক্ষমা করে এবার যেন এক নতুন সূর্যোদয় হোক, সূচনা হোক এক নতুন যুগের।
“শুয়ে' শুয়ে–মোরা দেখিব
আকাশ-আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ-সব
সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত,
একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয়ে
বারবার,
তুমি কি জানো তা ভাই?”