August 7, 2020

মোর রবি




                “কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস,
                      ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান।
                     কোথায় উষার আলো, কোথায় আকাশ।
                                           এ চির পুর্ণিমারাত্রি হোক অবসান”।                              

কলঙ্কিনী ব্রিটিশ শাসনের অন্ধকূপে ধুঁকছে তখন আমার মাতৃভূমি জীর্ণ-শীর্ণ-ভুভুক্ষের মত মৃতপ্রায় হয়ে চেয়ে রয়েছে এক চিলতে আলোর আশায়; প্রতীক্ষা শুধুমাত্র এক টুকরো ছায়ার

ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ভারত তখন ১৮৬১-তে আর ‘আমার সোনার বাংলা’ ১২৬৮। হিসেব মতন, ‘বন্দি’ ভারতবর্ষের মাটিতে সবেমাত্র একশো বছরের সেঞ্চুরি সেরে গুটিগুটি পায়ে পরবর্তী একশোর পথে ধাবমান তথাকথিত “সাদা চামড়ার” কালো শাসন চারিদিকে নৃশংসতার রক্তে বর্ণময় ভূ-ভারত; নিপীড়নের কান্নায় ধ্বনিত তখন শহর থেকে নগর। তীব্র চঞ্চল্যতার মাঝেই বৈশাখের ২৫শে ‘তুমি বরনে বরনে কিরণে কিরণে’ চিরসবুজের অঙ্গীকার হয়ে প্রস্ফুটিত হলে নিষ্প্রাণ এই ভূখণ্ডে; নিজের তেজস্বী আলোকচ্ছটায় রাঙিয়ে তুললে বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষকে। সমগ্র প্রকৃতি উচ্ছ্বোসিত কন্ঠে জানালো তোমায় আগমনীর শুভেচ্ছা-
 
                               “হে নূতন, 
                     দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ”।।

কোন বন্ধনই পারেনি তোমায় গন্ডীবদ্ধ করতেতাই দেওয়ালবন্দী শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করলে উন্মুক্ত আকাশতলে। সৃষ্টি করলে বিশ্বভারতী, রাঙিয়ে তুললে শান্তিনিকেতন; বিশ্বের দরবারে মেলে ধরলে তোমার মুক্ত চেতনাকে। তোমার ছায়ায় একটু একটু করে বেড়ে উঠলো রুক্ষ-শুষ্ক চারাগাছ, তোমার কিরণে উজ্জীবিত হল শত-সহস্র প্রাণ; নতুনভাবে গর্জে উঠলো শোষিত মানবসমাজ। ‘স্বদেশী’ তকমা তোমার নয়, তুমি তো বাঁধনছাড়া এক বনের পাখি; সব বিশেষণের বাঁধনিই যে আলগা তোমার কাছে

                    “তোমায় কেমনে বর্ণিব তা জানি না আমি,
                       তুমি যে নিজেই উন্মুক্ত পত্র একখানি।
                      অন্তরজাল-মুক্তকোষ, সবেতেই আছো তুমি-
                      পঠন-পাঠন-লেখনী’তে হয়ে তুমি ‘রবি”।।

কলমের কালিমায় কতবার রক্তাক্ত করেছো ব্রিটিশের শাসনরাজ’কে; বাধ্য হয়ে সেও একদিন মাথা নোয়ালো এসে তোমার সম্মুখেযাকে ভালোবেসে ত্যাগ করলে তুমি ‘নাইট’ উপাধি; যার ক্ষত-বিক্ষত হাতটি ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলে নতুন আলোর পথে, সে’ই ভারতবর্ষ যখন মুক্ত হল তুমি রইলে না আর সাথে। কত বিদ্রোহে, কত বিপ্লবেই সাথী ছিলে, পাশে ছিলে পরোক্ষভাবে; আজও আছো আমি জানি সর্বদা-চারিপাশে আমার ‘রবি’ হয়ে।

                 “পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোনখানে
                        তোমার পরশ আসে কখন কে জানে।
                            কি অচেনা কুসুমের গন্ধে,
                            কি গোপন আপন আনন্দে
                            কোন পথিকের কোন গানে
                         তোমার পরশ আসে কখন কে জানে”।।  

পার্থিব্যের মায়া কাটিয়ে আজ তুমি বিহঙ্গ। মুক্ত কতটা আজও তুমি জানি না তা আমি, তবে আজ তুমি ক্ষত-বিক্ষত সেটা আমি জানি। যাকে তুমি সৃষ্টি করেছিলে তোমার কোমলতা-স্নিগ্ধতার পরশে, আজ সে’ই ধর্ষিত হচ্ছে নিরাপত্তার অভাবে। একবিংশ শতাব্দীর মধ্য-গগণে আজ ভাঙছে তোমার শব্দ, আঁচড়ে ছিন্ন-ভিন্ন হচ্ছে তোমার সুরের মায়াজাল। অভিনবত্বের ছোঁয়ায় আজ তুমি বড্ড পুরাতন, নতুন সুরে তোমার শব্দ বোধহয় তাই আজ প্রাণহীন। ‘প্যাগোডি’র ছোঁয়াচে রোগে এখন তুমিও আক্রান্ত, কোন ওষুধে সারবে এই ব্যাধি তা এখনও এক সুত্রবিহীন অঙ্ক। 

                                “বেসুর বাজে রে,
                     আর কোথা নয়, কেবল তোরই আপন-মাঝে রে।।
                     মেলে না সুর এই প্রভাতে   আনন্দিত আলোর সাথে,
                         সবারে সে আড়াল করে, মরি লাজে রে।।
                                ওরে থামা রে ঝঙ্কার”।।

নানারকমের শুভ উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে দেশের প্রতীক হয়ে তুমি উচ্চারিত আপামর ভারতীয় কন্ঠে। তাও কতজনের কাছে তোমার এই সৃষ্টির নৈপথ্য আজও অপিরিচিত। হিন্দি মোদের দাপ্তরিক ভাষা, তাই শব্দোচ্চারণের ভঙ্গিমাও একটু আলাদাকিন্তু বাঙালি কণ্ঠেও বাংলা শব্দে এখন সেই অবাঙালী ছোঁয়া। আজ নিজের দেশেই তুমি সত্যি বড়ো উপেক্ষিত নবগঠিত ওয়েস্টার্ন মানবিকতার পটভূমিকায় তবুও, আমার রবি’র চ্ছটার উজ্জ্বলতা এতটাই, তাই হয়ত তথাকথিত বিদেশি চিন্তাভাবাপন্নে মগ্ন মানুষের মাঝে কিছু কিছু জনের মধ্যেও তোমার মৌলিক স্বত্ত্বা আজও বিরাজমান। তাঁদের মধ্যে দিয়ে আজও তুমি জীবিত, আজও তুমি সচল; চিরসবুজ।   

               " রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব উদয়গিরিভালে-
                 গাহে বিহঙ্গম, পূণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
              তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
                            তব চরণে নত মাথা।
                 জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
                 জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে”।।

No comments:

Post a Comment