শ্রীচরণেষু মা,
কেমন আছো? জানি, আমার কথা চিন্তা করতে করতে অর্ধেক দিনই প্রেসারের ওষুধটা খেতে ভুলে যাচ্ছ . . . কিংবা খেয়ালই রাখছ না, শেষ কবে তোমার routine check-up হয়েছিল। এখন তো অবশ্য বলতে গেলে সবকিছুতেই lock-down’এর শিলমোহর পড়ে গেছে। না বাইরে সাহস করে বেরনো যাচ্ছে, না একটানা বসে থাকা যাচ্ছে বাড়িতে।
জানো মা, চার দেওয়ালের ভেতরের গণ্ডীটা কী ভীষণ ছোট হয়ে আসছে রোজ রোজ। আমার এই তিন
কামরার ফ্ল্যাট’টা যেন গিলে খেতে আসছে আমাকে প্রতিটা মুহুর্তে। যেটুকু সময় ঘুমিয়ে
থাকছি, ততক্ষণই ভাল লাগছে . . . কিন্তু আজকাল জানো মা, ঘুমটাও না কেমন যেন ধীরে
ধীরে চলে যাচ্ছে!
Quarantine’এর কবলে পড়ে work
from home করছি, খাচ্ছি আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডাটাও এখন online’এই সারছি। কিন্তু এই বন্দী জীবন কতদিনই বা আর কাটানো যায়, তুমিই বল! আজ,
একমাস হয়ে গেল বাড়ির বাইরে পা পর্যন্ত রাখিনি। আচ্ছা মা, তুমি কি করে পারলে গো,
এতগুলো বছর মুখ বুজে একইভাবে বাড়িতে কাটিয়ে দিতে? তোমার বাড়ির বাইরে পা রাখা বলতে
ছিল, শুধুমাত্র মামারবাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি আর নয়ত খুব বেশি দূর হলে সেই একঘেয়ে
পুরী কিংবা দার্জিলিং। এই চিরাচরিত গণ্ডীর বাইরে তুমি আজ পর্যন্ত কখনো বেরিয়েছ বলে
আমার মনে পড়ে না। কি করে পারলে মা, তুমি দীর্ঘ এত বছর ধরে রোজনামচা আর একঘেয়েমির
সাথে সংসার করতে!
অথচ ছোটবেলায় আমি স্কুল থেকে, বাবা অফিস থেকে ফিরে কতই না হম্বিতম্বি করেছি তোমার
উপর। বেরনোর সময় স্নানের জল’টা দিতে তোমার একটু দেরি হলে হয়ত তোমাকে কিঞ্চিৎ হলেও
দোষারোপ করেছি! তুমি হাঁপিয়ে যেতে না মা? আমাদের তাড়াহুড়ো’র সাথে পাল্লা দিতে
তোমার তখন খুব কষ্ট হত না, মা? নাকি বিয়ের মন্ত্র পড়ার সময় কেউ সহ্য করার মন্ত্রটাও
কানে কানে তোমাকে বলে দিয়েছিল! চুপচাপ সংসারের ঘানি টানবে বলেই কি নিজের সব
ভালোলাগা-ভালোবাসা-স্বপ্ন’কে বিয়ের অগ্নিকুণ্ডে আহুতি দিয়ে আমাদের বাড়িতে প্রবেশ
করেছিলে?
তুমি ছিলে গৃহবন্দী একজন স্ত্রী আর গতিময়তা-Modernization’এর চাকায়
পিষতে থাকা একজন মা। শব্দের অধিকার তোমারও ছিল, সেটা প্রয়োগও
করেছ বহুবার! কিন্তু, কই! . . . তখন তো আমি কান দিইনি একটুও। সামান্য সময়টুকুও
দিয়ে ভাবিনি আমি, তোমার সেইসব শব্দের গভীরতাকে। আসলে, “ কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে
দংশেনি যারে?”
রাতে যখন আমার ঘুম আসত না মা, আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, “সারাদিন তো তোমায় কিছুই করতে
হয় না। খুন্তি নাড়া, ঝাড় পোঁছ; এই তো তোমার দুনিয়া! . . . তার বাইরে তুমি কিছু কি
জানো? প্রতিদিন ট্রেনে-বাসে ঝুলতে ঝুলতে যাওয়ার কষ্ট তুমি কি বুঝতে পারবে? সারাদিন
তো বাড়িতে পাখার তলায় বসে কাজ করছ! . . . রোদ-ঝর-জল-বৃষ্টি মাথায় করে ভিড়ের মধ্যে
গুঁতোগুঁতি করে কাজ করতে যাওয়ার মর্ম তুমি আর কি করে জানবে! কতগুলো সকাল কেটেছে
তোমার মুখে এই কথাটা শুনে, “কাল রাতে ঘুমটা ঠিক হল না”। “কেন জানি না আজকাল ঘুমটা
তেমন আসে না”। তুমি বলতে . . . আর আমি শুনতাম! তোমার এই ঘুম না আসার পেছনের যন্ত্রণাটা
বুঝিনি তখন . . . নাকি, বুঝতে চাইনি। নিজেকে নিয়ে আপন খেয়ালেই আমার কেটে যেত দিনের
পর দিন।
কখনো হয়ত রাগের মাথায় বলেই বসতাম, “তুমি আর কি বুঝবে? থাকো তো সারাদিন বাড়িতেই! কাজ
তো খালি তোমার রান্নাবান্না আর ঘর গোছানো; শুধু এইটুকু পরিশ্রমে কি আর ঘুম আসে?”
অভিযোগ . . . অভিযোগ আর অভিযোগ। পাহাড়প্রমাণ অভিযোগের বোঝা তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে
দিতাম; কিন্তু তুমি! উফফফ, পর্যন্তও করতে না কখনো! কেন মা? আমার এই যুক্তিহীন
নালিশের কেন কোন উত্তর দাওনি কখনো? . . . কেন তোমাকে বুঝতে বাধ্য করোনি আমাকে? . .
. কখনো নীরব শ্রোতার ভূমিকায় থাকতে আবার কখনো তোমার ঠোঁটের কোণায় ভেসে উঠত এক
চিলতে হাসি।
বুঝিনি তখন সেই নীরবের স্তব্ধতাকে . . . উপলব্ধি করতে পারিনি তোমার সেই এক চিলতে
হাসির ভেতরে লুকিয়ে থাকা অভিমান’কে। অভিমান! জানি, অনেক অনেক অভিমান মনের মধ্যে
পুষে রেখে নিঃশব্দে একটা একটা করে দিন কাটিয়ে চলেছ অবিরত। আর সান্ত্বনা দিয়ে চলেছ
নিজেকে এই ভেবে, যে তোমাকে উপলব্ধি করার জন্য বোধহয় এই দুনিয়ায় কেউ নেই! নেই কেউ .
. . তোমার কাঁধে হাতটা রেখে তোমার সবকিছু’কে ভাগ করে নেওয়ার জন্য।
আমি জানি, মা, আমার জন্য একরাশ অভিমান জড়ো করে রেখেছ নিজের মনের মধ্যে। তোমাকে আমি
চিনি মা, আমি জানি . . . “তোমার বুক ফাটলেও, মুখ কখনোই খুলবে না”। আজ নিজেকে জানো,
খুব অপরাধী লাগছে, স্কুল থেকে ফিরে এসে বন্ধুদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি হওয়ার কথা তোমাকে যখন
বলতাম, কিংবা সেই রাগের রেশটা যখন তোমার উপর ফেলতাম, তুমি শান্ত মনে আমাকে
বুঝতে-বোঝাতে। কই আমি তো কখনো তোমার ক্ষেত্রে সেটা করিনি। কিন্তু . . . কেন? নিজের
স্কুল-কলেজ-পড়াশুনো-বন্ধুবান্ধব’এর মগ্নতাই কি আমাকে তোমার থেকে একটু একটু করে সরিয়ে নিয়ে গেছে “দূর-দিগন্তে”!
তোমার জীবনের এতগুলো বছরের সবরকম হিসেব-নিকেশ মাত্র একমাসেই জলের মত পরিষ্কার হয়ে
গেল আমার কাছে। আজ আমাদের মধ্যেকার ভৌগোলিক দুরত্বের পরিধি নিজের অজান্তেই আমাদের
মনের দূরত্বের বাস্তবতাকে আমার চোখের সামনে মেলে ধরল জলছবির মত করে। তোমার সব
নিরাবতাকে এক উন্মুক্ত পত্রের আকারে তুলে ধরল আমার মনের আয়নায়।
আমার তো সবে এক মাস হল, মা, তোমার তো অর্ধেকের বেশি জীবনটাই কেটে গেল Quarantine’এ। নিজের যত্ন নিও মা, এবার একটু
নিজের জন্য বাঁচো, নিজেকে নিয়ে বাঁচো। আমি আছি তোমার পাশে, থাকবও সারাজীবন।
ইতি,
তোমার মিষ্টু