May 10, 2020

বন্ধন





শ্রীচরণেষু মা,


কেমন আছো? জানি, আমার কথা চিন্তা করতে করতে অর্ধেক দিনই প্রেসারের ওষুধটা খেতে ভুলে যাচ্ছ . . . কিংবা খেয়ালই রাখছ না, শেষ কবে তোমার
routine check-up হয়েছিল। এখন তো অবশ্য বলতে গেলে সবকিছুতেই lock-downএর শিলমোহর পড়ে গেছে। না বাইরে সাহস করে বেরনো যাচ্ছে, না একটানা বসে থাকা যাচ্ছে বাড়িতে।

জানো মা, চার দেওয়ালের ভেতরের গণ্ডীটা কী ভীষণ ছোট হয়ে আসছে রোজ রোজ। আমার এই তিন কামরার ফ্ল্যাট’টা যেন গিলে খেতে আসছে আমাকে প্রতিটা মুহুর্তে। যেটুকু সময় ঘুমিয়ে থাকছি, ততক্ষণই ভাল লাগছে . . . কিন্তু আজকাল জানো মা, ঘুমটাও না কেমন যেন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে!  

Quarantineএর কবলে পড়ে work from home করছি, খাচ্ছি আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডাটাও এখন online’এই সারছি। কিন্তু এই বন্দী জীবন কতদিনই বা আর কাটানো যায়, তুমিই বল! আজ, একমাস হয়ে গেল বাড়ির বাইরে পা পর্যন্ত রাখিনি। আচ্ছা মা, তুমি কি করে পারলে গো, এতগুলো বছর মুখ বুজে একইভাবে বাড়িতে কাটিয়ে দিতে? তোমার বাড়ির বাইরে পা রাখা বলতে ছিল, শুধুমাত্র মামারবাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি আর নয়ত খুব বেশি দূর হলে সেই একঘেয়ে পুরী কিংবা দার্জিলিং। এই চিরাচরিত গণ্ডীর বাইরে তুমি আজ পর্যন্ত কখনো বেরিয়েছ বলে আমার মনে পড়ে না। কি করে পারলে মা, তুমি দীর্ঘ এত বছর ধরে রোজনামচা আর একঘেয়েমির সাথে সংসার করতে! 

অথচ ছোটবেলায় আমি স্কুল থেকে, বাবা অফিস থেকে ফিরে কতই না হম্বিতম্বি করেছি তোমার উপর। বেরনোর সময় স্নানের জল’টা দিতে তোমার একটু দেরি হলে হয়ত তোমাকে কিঞ্চিৎ হলেও দোষারোপ করেছি! তুমি হাঁপিয়ে যেতে না মা? আমাদের তাড়াহুড়ো’র সাথে পাল্লা দিতে তোমার তখন খুব কষ্ট হত না, মা? নাকি বিয়ের মন্ত্র পড়ার সময় কেউ সহ্য করার মন্ত্রটাও কানে কানে তোমাকে বলে দিয়েছিল! চুপচাপ সংসারের ঘানি টানবে বলেই কি নিজের সব ভালোলাগা-ভালোবাসা-স্বপ্ন’কে বিয়ের অগ্নিকুণ্ডে আহুতি দিয়ে আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করেছিলে? 

তুমি ছিলে গৃহবন্দী একজন স্ত্রী আর গতিময়তা-Modernizationএর চাকায় পিষতে থাকা একজন মা। শব্দের অধিকার তোমারও ছিল, সেটা প্রয়োগও করেছ বহুবার! কিন্তু, কই! . . . তখন তো আমি কান দিইনি একটুও। সামান্য সময়টুকুও দিয়ে ভাবিনি আমি, তোমার সেইসব শব্দের গভীরতাকেআসলে, “ কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?” 

রাতে যখন আমার ঘুম আসত না মা, আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, “সারাদিন তো তোমায় কিছুই করতে হয় না। খুন্তি নাড়া, ঝাড় পোঁছ; এই তো তোমার দুনিয়া! . . . তার বাইরে তুমি কিছু কি জানো? প্রতিদিন ট্রেনে-বাসে ঝুলতে ঝুলতে যাওয়ার কষ্ট তুমি কি বুঝতে পারবে? সারাদিন তো বাড়িতে পাখার তলায় বসে কাজ করছ! . . . রোদ-ঝর-জল-বৃষ্টি মাথায় করে ভিড়ের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করে কাজ করতে যাওয়ার মর্ম তুমি আর কি করে জানবে! কতগুলো সকাল কেটেছে তোমার মুখে এই কথাটা শুনে, “কাল রাতে ঘুমটা ঠিক হল না”। “কেন জানি না আজকাল ঘুমটা তেমন আসে না”। তুমি বলতে . . . আর আমি শুনতাম! তোমার এই ঘুম না আসার পেছনের যন্ত্রণাটা বুঝিনি তখন . . . নাকি, বুঝতে চাইনি। নিজেকে নিয়ে আপন খেয়ালেই আমার কেটে যেত দিনের পর দিন। 

কখনো হয়ত রাগের মাথায় বলেই বসতাম, “তুমি আর কি বুঝবে? থাকো তো সারাদিন বাড়িতেই! কাজ তো খালি তোমার রান্নাবান্না আর ঘর গোছানো; শুধু এইটুকু পরিশ্রমে কি আর ঘুম আসে?” অভিযোগ . . . অভিযোগ আর অভিযোগ। পাহাড়প্রমাণ অভিযোগের বোঝা তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতাম; কিন্তু তুমি! উফফফ, পর্যন্তও করতে না কখনো! কেন মা? আমার এই যুক্তিহীন নালিশের কেন কোন উত্তর দাওনি কখনো? . . . কেন তোমাকে বুঝতে বাধ্য করোনি আমাকে? . . . কখনো নীরব শ্রোতার ভূমিকায় থাকতে আবার কখনো তোমার ঠোঁটের কোণায় ভেসে উঠত এক চিলতে হাসি। 

বুঝিনি তখন সেই নীরবের স্তব্ধতাকে . . . উপলব্ধি করতে পারিনি তোমার সেই এক চিলতে হাসির ভেতরে লুকিয়ে থাকা অভিমান’কে। অভিমান! জানি, অনেক অনেক অভিমান মনের মধ্যে পুষে রেখে নিঃশব্দে একটা একটা করে দিন কাটিয়ে চলেছ অবিরত। আর সান্ত্বনা দিয়ে চলেছ নিজেকে এই ভেবে, যে তোমাকে উপলব্ধি করার জন্য বোধহয় এই দুনিয়ায় কেউ নেই! নেই কেউ . . . তোমার কাঁধে হাতটা রেখে তোমার সবকিছু’কে ভাগ করে নেওয়ার জন্য। 

আমি জানি, মা, আমার জন্য একরাশ অভিমান জড়ো করে রেখেছ নিজের মনের মধ্যে। তোমাকে আমি চিনি মা, আমি জানি . . . “তোমার বুক ফাটলেও, মুখ কখনোই খুলবে না”। আজ নিজেকে জানো, খুব অপরাধী লাগছে, স্কুল থেকে ফিরে এসে বন্ধুদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি হওয়ার কথা তোমাকে যখন বলতাম, কিংবা সেই রাগের রেশটা যখন তোমার উপর ফেলতাম, তুমি শান্ত মনে আমাকে বুঝতে-বোঝাতে। কই আমি তো কখনো তোমার ক্ষেত্রে সেটা করিনি। কিন্তু . . . কেন? নিজের স্কুল-কলেজ-পড়াশুনো-বন্ধুবান্ধব’এর মগ্নতাই কি আমাকে তোমার থেকে একটু একটু করে সরিয়ে নিয়ে গেছে “দূর-দিগন্তে”! 

তোমার জীবনের এতগুলো বছরের সবরকম হিসেব-নিকেশ মাত্র একমাসেই জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। আজ আমাদের মধ্যেকার ভৌগোলিক দুরত্বের পরিধি নিজের অজান্তেই আমাদের মনের দূরত্বের বাস্তবতাকে আমার চোখের সামনে মেলে ধরল জলছবির মত করে। তোমার সব নিরাবতাকে এক উন্মুক্ত পত্রের আকারে তুলে ধরল আমার মনের আয়নায়। 

আমার তো সবে এক মাস হল, মা, তোমার তো অর্ধেকের বেশি জীবনটাই কেটে গেল Quarantine’এ।  নিজের যত্ন নিও মা, এবার একটু নিজের জন্য বাঁচো, নিজেকে নিয়ে বাঁচো। আমি আছি তোমার পাশে, থাকবও সারাজীবন। 


 ইতি,

তোমার মিষ্টু  




May 1, 2020

শ্রমিক দিবসের হাল-হকিকত






ছেলেবেলায় স্কুলের বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের সর্বকালীন পঠিত একার্থক শব্দ “শ্রমিক= যারা শ্রম করে”।কিন্তু . . . তার অর্থ! 



আচ্ছা! ‘শ্রমিক’ . . কাকে বলে? ওই যে মিস্ত্রী, মুটে-মজুর, বাড়ির কাজের মাসি, কর্পরেশনের নর্দমা পরিষ্কারের লোক, এদেরই তো বলে . . . ‘শ্রমিক’। 

প্রকৃত উত্তরটা সত্যিই কি এতটা রুক্ষ-নির্মম, . . . এতটাই অমানবিক!??

না। এই গোটা বিশ্বসভ্যতার প্রতিটি ইট, বালি, পাথরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়িয়ে রয়েছে যাদের; যারা মানবসৃষ্ট ‘চতুর্বর্ণ’এর এক্কেবারে নিম্নে অবস্থান করছে; হয়ত কখনোই যারা এই সমাজের আশির্বাদধন্য শ্রেণীর চৌহদ্যিতেও জায়গা পাবে না- তারাই আমাদের এই রুঢ় গণতান্ত্রিক সমাজের ‘শূদ্র’ তথা ‘শ্রমিক’ জাতি; যদিও মানবসভ্যতার সবথেকে উপেক্ষিত এই সর্বশেষ ‘বর্ণ’ই স্থান পেল বিশ্ব ইতিহাসে। লেলিহান শিখার মত জ্বলে উঠলো বইয়ের পাতায়    

বর্তমান সময় থেকে একটু পিছিয়ে গেলাম অকথিত-অবর্ণিত অতীতের পথে . . .

সাল ১৮৭৫। এই অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে শ্রমিকদের উপর চলতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা অকথ্য পরিশ্রম আর বিনিময়স্বরুপ নূন্যতম মজুরীর অনিশ্চিয়তা। দীর্ঘদিনের এই অত্যাচারের পারদ বাড়তে বাড়তে ছাড়িয়ে গেল বিপদসীমা; সময় তখন ১৮৭৬। গর্জে উঠল 'শ্রমিক' সমাজ। অনধিক ১০ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারনের দাবিতে শুরু হল আন্দোলন, রাস্তায় নামল মিছিল; কেন্দ্রবিন্দু শিকাগো'র হে মার্কেট। সরব হল পেনিসিলভিয়া-শিকাগোসহ গোটা যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু শেষবর্ণের স্ব'অধিকারের বিরুদ্ধে ওঠা এই ধ্বনিত কন্ঠ নীরব হয়ে গেল ব্রিটিশ সেনার গুলিতে; সারিয়ে গেল বহু প্রাণ, আঘাত পেল অসংখ্য দেহ, আর ছারখার হল অগণিত মন। আরও তীব্রতার সাথে এগিয়ে চলল মিছিল; সঙ্গে আত্মবলের 'লাল'ধ্বজার ন্যায় মৃত শ্রমিকদের রক্তাক্ত শার্ট। 

 “বেরিয়েছি যখন পথে, পথই এখন ঘর,
আঁধার ভেঙে এগিয়ে যেতে আর পাইনে ডর।
থেমে যাওয়ার নাম মৃত্যু অজানা কারো নয়, 
না থেমে তাই এগিয়ে চলি ভয়’কে করে জয়”।।

১লা মে থেকে ৫ই মে টানা ৪দিনে গড়াল মিছিলের চাকা। নিহতের সংখ্যা বেড়ে আরও ৪
গ্রেফতার হল শত সহস্র শ্রমিক; আর তাদের পরিণাম! মৃত্যুদণ্ড।

 “অসদো মা সদ্গময়ঃ তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ
ওম মৃত্যর্মা অমৃতমঃ গময়ঃ শান্তি শান্তি ওম
শান্তি ওম, শান্তি ওম, শান্তি ওম, হরি ওমতদসদ”।।

হাজারো প্রাণের এই নির্মম বলিদান মর্যাদা পেল ১৮৮৮ সালে। আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবারের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেন্ট লুইস শ্রমিক সম্মেলনে কাজের সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণের দাবিতে মে দিবসপালনের ঘোষণা করা হলপরের বছর, ১৮৮৯’তে কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের প্যারিস সম্মেলনে ১লা মে তারিখটিতে বিশ্বব্যাপী ‘শ্রমিক-শ্রেণির আন্তর্জাতিক দিবস’ হিসেবে পালনের শিলমোহর পড়লো।
আন্তর্জাতিক ‘ছুটি’ দিবসের মান্যতা পেয়ে ক্যালেন্ডারে রাঙায়িত ‘১লা মে’ কিন্তু এই দিনটির নৈপথ্যে যাদের আত্মদান ও সংগ্রাম মিলেমিশে রয়েছে; তাদের জন্য কিন্তু বার্ষিক ক্যালেন্ডারে শুধু এই একটা দিনই বরাদ্দ। অনেকটা ২৩শে জানুয়ারি, ১৫ই আগস্ট বা ‘মাতৃদিবস’এর মতসবরকম ভক্তি-ভালবাসা-উৎযাপনের আয়ু ওই একদিনেই।

“শ্লোগান শুনি, বক্তৃতা হয়-
শ্রমিক দিবস আসে
দিন চলে যায়, কেউ থাকে না,