August 21, 2020

ফ্যাশনিস্তার বাড়বাড়ন্ত

 




‘ধরন’, ‘চলন’ বা ‘ফ্যাশন’- এমন একটি বিষয় যাকে কোন ভৌগোলিক সীমারেখায় বা সময়ের খাঁচায় বন্দী করা যায় না। উনবিংশ শতাব্দীর স্বর্ণযুগীয় সিনেম্যাটিক ‘ফ্যাশন’ থেকে শুরু করে আজ একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটলাইজড ওয়েস্টার্ন ‘ফ্যাশন’; এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুর পাশাপাশি ‘ফ্যাশন’ জগতেও পরিবর্তন এসেছে আমূল। সেও পাল্টেছে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে; নিজেকে করে তুলেছে এখনকার ভাষায় ‘আপগ্রেডেড’। আমাদের মানসিকতার সাথে ‘ফ্যাশনেও লেগেছে পাশ্চাত্যের হাওয়া। বছর-যুগ-শতাব্দী ধরে চলে আসা নবীন প্রবীণের দলাদলির মাঝেও ‘ফ্যাশন’-এর চাকা এগিয়ে চলেছে অবিরত, সঙ্গে নিয়ে অভিনবত্বের হাল্কা-মিষ্টি ছোঁয়া
                     
          “অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত,
                          সবেতেই বিরাজমান।
                       সময়ের সাথে রদবদল হলেও-
                       ‘ফ্যাশন’, তুমিই মহারাজ”।।

তিন অক্ষরের এই ইংরেজি শব্দটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে, অগুনিত অর্থ গরগড়িয়ে সামনে এসে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পরবে। ঠিক তেমনই এই শব্দের প্রকৃতিও একেবারে একরকম . . . অগুনিত। গতিময়তার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে নিজেকে পরিবর্তনযোগ্য করে চলেছে প্রতিনিয়ত


বাঙ্গালিয়ানা থেকে বিদেশিয়ানা; সবেতেই ‘ফ্যাশন’ অতুলনীয়। একটা সময় এসেছিল যখন সর্বধর্ম নির্বিশেষে ‘ট্রেডিশনাল’ পোশাকের ব্যবহারে অনিহা দেখা দিয়েছিল; কিন্তু এই ‘ফ্যাশন’এর হাত ধরেই তারা আবার স্বসন্মানে নতুনভাবে ফিরে এল আমাদের কাছে। উদাহরণস্বরূপ, এই যেমন বাঙালির চিরাচরিত ‘ড্রেস কোড’; শাড়ি আর ধূতি-পাজামা’কেই ধরে নি। তাকেও কিন্তু নিজের যাদুতে সম্পুর্ণভাবে মেকওভার করে নতুন মোড়কে সে মেলে ধরলো বর্তমান যুবসমাজের কাছে। অন্যদিকে, হালের ওয়েস্টার্ন পোশাকেও ‘ফ্যাশন’এর বিবর্তনের ধারা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল
                

‘ভালবাসা’ কিংবা ‘ভাললাগা’র পরিধিটা যতই বড় হোক না কেন, সর্বপ্রথম স্থানটা বরাদ্দ থাকে আমাদের নিজেদের জন্যই। কারণ, আমরা নিজেকেই তো প্যাম্পার করি সবথেকে বেশি। 

“আমি' আমাকে লালন করি-
                     আমার অপরিমেয় ভালবাসায়
                   আবার আমিই আমাকে
পালন করি-
                      অপরিসীম ভালোলাগায়”

প্রতিনিয়ত নিজের সাথে কিংবা বলতে পারি নিজের ওপরেই আমরা নানারকমভাবে এক্সপেরিমেন্ট করেই চলেছি ক্রমাগত। আদব-কায়দা, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, সাজ-সজ্জা, এমনকি জুয়েলারিতেও আমরা ফ্যাশনেবল হয়ে উঠছি দিনদিন। উপলক্ষ্য, অনুষ্ঠান ছাড়াও সবসময়ই নিজেকে আপগ্রেডেড করে চলেছি সর্বক্ষন। কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবাই তাদের পছন্দমতন রাঙিয়ে তুলেছে নিজেদের। অদলবদল ঘটেছে তাদের মানসিকতায়ও, সমাজের দৃষ্টিও পালটেছে অনেকটা। সবাই আমরা এগিয়ে চলেছি যুগের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে। আপন করে নিয়েছি আবহহাওয়ার এই ‘ফ্যাশনেবল’ পরিবর্তনকে
                     “পুরাতন’কে সাথে নিয়ে,
                      বরণ করে নবীন’কে-
                      নতুন পথে পা বারিয়ে
                    চিনতে শিখলাম জগতটাকে”।।

শত-সহস্র
ভিড়ের মাঝে নিজেকে একটু অন্যভাবে দেখতে কার না ভালো লাগে। আর তাই, সময়ের সাথে নিজেকে একটু একটু করে বদলে ফেলা; আর এই বদলের হৈ-হট্টগোলে আজ যা ‘ফ্যাশনে ইন’, কাল সেটাই আবার ‘ফ্যাশনে আউট’লড়াই এড়াতে প্রবীণ পিছিয়ে যায়, জায়গা করে দেয় নবীনকে। ‘ওল্ড ইস গোল্ড’ প্রবাদ বাক্যটির হাত ধরে হালকা ছিটেফোঁটা নতুন মিশিয়ে সেই ‘ব্যাক ডেটেড’ প্রবীণরাই আবার ফিরে আসে নতুন মোড়কেফ্যাশনের মায়াজালে বাচ্ছা থেকে বুড়ো বলতে গেলে এখন সবাই কুপোকাত। আসলে, ‘ফ্যাশন’ যে ‘চিরযৌবনা’, যার নেই কোন বয়সসীমা।

তবে এই ফ্যাশন দুনিয়ায় বেশ কিছু বছর হল দুই নতুন সদস্য যোগদান করেছে; ‘ট্যাটু’ আর ‘পিয়ারসিং’। এই মুহুর্ত্যে এই বিশেষ্যপদ দুটি মার্কেটে খুবই জনপ্রিয় যদিও ভালো করে দেখলে এই দুই শব্দেরও তেমন কোন ‘এজ লিমিটেশন’ নেই। যুবক-যুবতী থেকে বয়স্ক সবাই এখন এতে মগ্ন। সত্যিই . . . তিন অক্ষরের এই ইংরেজি শব্দটির এলেম আছে বলতে হবে! দেশীয় চাল-চলনের সাথে ওয়েস্টার্ন কালচারকে ফেবিকল দিয়ে এমন জুড়েছে, যে সে বন্ধন খোলার জো এই দুনিয়ায় কারোর নেই।

শব্দের অভিধানে ‘ফ্যাশন’ শব্দের হরেকরকম অর্থ থাকলেও; তার প্রকৃত অর্থ হল মানুষের দৃশ্যমান সৃজনশীলতা, যা তাঁর শারীরিক সৌন্দর্য এবং তার ব্যক্তিত্বকে উন্নত করে। তাই এটা বলাই বাহুল্য, ‘ফ্যাশন’ প্রতিটি মানুষের জীবনে ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে
। প্রয়োজন শুধু সঠিকজায়গায় তার সুব্যবহার।

এই বিষয়ে Italian Fashion Designer, Giorgio Armani’র একটা quotation মনে পড়ে গেল-

“Elegance is not standing out, but being remembered.”
 

August 7, 2020

মোর রবি




                “কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস,
                      ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান।
                     কোথায় উষার আলো, কোথায় আকাশ।
                                           এ চির পুর্ণিমারাত্রি হোক অবসান”।                              

কলঙ্কিনী ব্রিটিশ শাসনের অন্ধকূপে ধুঁকছে তখন আমার মাতৃভূমি জীর্ণ-শীর্ণ-ভুভুক্ষের মত মৃতপ্রায় হয়ে চেয়ে রয়েছে এক চিলতে আলোর আশায়; প্রতীক্ষা শুধুমাত্র এক টুকরো ছায়ার

ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ভারত তখন ১৮৬১-তে আর ‘আমার সোনার বাংলা’ ১২৬৮। হিসেব মতন, ‘বন্দি’ ভারতবর্ষের মাটিতে সবেমাত্র একশো বছরের সেঞ্চুরি সেরে গুটিগুটি পায়ে পরবর্তী একশোর পথে ধাবমান তথাকথিত “সাদা চামড়ার” কালো শাসন চারিদিকে নৃশংসতার রক্তে বর্ণময় ভূ-ভারত; নিপীড়নের কান্নায় ধ্বনিত তখন শহর থেকে নগর। তীব্র চঞ্চল্যতার মাঝেই বৈশাখের ২৫শে ‘তুমি বরনে বরনে কিরণে কিরণে’ চিরসবুজের অঙ্গীকার হয়ে প্রস্ফুটিত হলে নিষ্প্রাণ এই ভূখণ্ডে; নিজের তেজস্বী আলোকচ্ছটায় রাঙিয়ে তুললে বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষকে। সমগ্র প্রকৃতি উচ্ছ্বোসিত কন্ঠে জানালো তোমায় আগমনীর শুভেচ্ছা-
 
                               “হে নূতন, 
                     দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ”।।

কোন বন্ধনই পারেনি তোমায় গন্ডীবদ্ধ করতেতাই দেওয়ালবন্দী শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করলে উন্মুক্ত আকাশতলে। সৃষ্টি করলে বিশ্বভারতী, রাঙিয়ে তুললে শান্তিনিকেতন; বিশ্বের দরবারে মেলে ধরলে তোমার মুক্ত চেতনাকে। তোমার ছায়ায় একটু একটু করে বেড়ে উঠলো রুক্ষ-শুষ্ক চারাগাছ, তোমার কিরণে উজ্জীবিত হল শত-সহস্র প্রাণ; নতুনভাবে গর্জে উঠলো শোষিত মানবসমাজ। ‘স্বদেশী’ তকমা তোমার নয়, তুমি তো বাঁধনছাড়া এক বনের পাখি; সব বিশেষণের বাঁধনিই যে আলগা তোমার কাছে

                    “তোমায় কেমনে বর্ণিব তা জানি না আমি,
                       তুমি যে নিজেই উন্মুক্ত পত্র একখানি।
                      অন্তরজাল-মুক্তকোষ, সবেতেই আছো তুমি-
                      পঠন-পাঠন-লেখনী’তে হয়ে তুমি ‘রবি”।।

কলমের কালিমায় কতবার রক্তাক্ত করেছো ব্রিটিশের শাসনরাজ’কে; বাধ্য হয়ে সেও একদিন মাথা নোয়ালো এসে তোমার সম্মুখেযাকে ভালোবেসে ত্যাগ করলে তুমি ‘নাইট’ উপাধি; যার ক্ষত-বিক্ষত হাতটি ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলে নতুন আলোর পথে, সে’ই ভারতবর্ষ যখন মুক্ত হল তুমি রইলে না আর সাথে। কত বিদ্রোহে, কত বিপ্লবেই সাথী ছিলে, পাশে ছিলে পরোক্ষভাবে; আজও আছো আমি জানি সর্বদা-চারিপাশে আমার ‘রবি’ হয়ে।

                 “পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোনখানে
                        তোমার পরশ আসে কখন কে জানে।
                            কি অচেনা কুসুমের গন্ধে,
                            কি গোপন আপন আনন্দে
                            কোন পথিকের কোন গানে
                         তোমার পরশ আসে কখন কে জানে”।।  

পার্থিব্যের মায়া কাটিয়ে আজ তুমি বিহঙ্গ। মুক্ত কতটা আজও তুমি জানি না তা আমি, তবে আজ তুমি ক্ষত-বিক্ষত সেটা আমি জানি। যাকে তুমি সৃষ্টি করেছিলে তোমার কোমলতা-স্নিগ্ধতার পরশে, আজ সে’ই ধর্ষিত হচ্ছে নিরাপত্তার অভাবে। একবিংশ শতাব্দীর মধ্য-গগণে আজ ভাঙছে তোমার শব্দ, আঁচড়ে ছিন্ন-ভিন্ন হচ্ছে তোমার সুরের মায়াজাল। অভিনবত্বের ছোঁয়ায় আজ তুমি বড্ড পুরাতন, নতুন সুরে তোমার শব্দ বোধহয় তাই আজ প্রাণহীন। ‘প্যাগোডি’র ছোঁয়াচে রোগে এখন তুমিও আক্রান্ত, কোন ওষুধে সারবে এই ব্যাধি তা এখনও এক সুত্রবিহীন অঙ্ক। 

                                “বেসুর বাজে রে,
                     আর কোথা নয়, কেবল তোরই আপন-মাঝে রে।।
                     মেলে না সুর এই প্রভাতে   আনন্দিত আলোর সাথে,
                         সবারে সে আড়াল করে, মরি লাজে রে।।
                                ওরে থামা রে ঝঙ্কার”।।

নানারকমের শুভ উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে দেশের প্রতীক হয়ে তুমি উচ্চারিত আপামর ভারতীয় কন্ঠে। তাও কতজনের কাছে তোমার এই সৃষ্টির নৈপথ্য আজও অপিরিচিত। হিন্দি মোদের দাপ্তরিক ভাষা, তাই শব্দোচ্চারণের ভঙ্গিমাও একটু আলাদাকিন্তু বাঙালি কণ্ঠেও বাংলা শব্দে এখন সেই অবাঙালী ছোঁয়া। আজ নিজের দেশেই তুমি সত্যি বড়ো উপেক্ষিত নবগঠিত ওয়েস্টার্ন মানবিকতার পটভূমিকায় তবুও, আমার রবি’র চ্ছটার উজ্জ্বলতা এতটাই, তাই হয়ত তথাকথিত বিদেশি চিন্তাভাবাপন্নে মগ্ন মানুষের মাঝে কিছু কিছু জনের মধ্যেও তোমার মৌলিক স্বত্ত্বা আজও বিরাজমান। তাঁদের মধ্যে দিয়ে আজও তুমি জীবিত, আজও তুমি সচল; চিরসবুজ।   

               " রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব উদয়গিরিভালে-
                 গাহে বিহঙ্গম, পূণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
              তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
                            তব চরণে নত মাথা।
                 জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
                 জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে”।।